দূষণ, আবর্জনার কবলে বাঁকখালী

শাহীন মাহমুদ রাসেল

প্রতিনিয়ত বর্জ্য ফেলায় দূষণের শিকার রামু, সদর ও নাইক্ষ্যংছড়ি তিন উপজেলার মাঝ দিয়ে প্রবহমান বাঁকখালী নদী। এখানে হাট-বাজার, বিভিন্ন পোল্টি ফার্ম ও আবাসিক এলাকার বর্জ্য সরাসরি ফেলার কারণে দিন দিন দূষণ বাড়ছে। এতে নদীনির্ভর স্থানীয় মানুষের দুর্ভোগ যেমন বাড়ছে, তেমনি প্রভাব পড়ছে মাছের জীবনচক্রে। দীর্ঘদিন ধরে বাজার ও ব্যস্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নদীতে বর্জ্য ফেললেও এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, দখল হয়ে যাচ্ছে নদীর দুই পাশ। নির্মিত হচ্ছে অবৈধ স্থাপনা। কক্সবাজার পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে ভরাট হয়ে গেছে নদীর অনেকাংশ। এ সুযোগে দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে ভূমিদ্যুরা।

দেখা যায়, শহরের একসময়ের বাণিজ্যিক জংশন হিসেবে পরিচিত বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট দখল হয়ে গেছে। সম্প্রতি কস্তুরাঘাটের কলার আড়ত থেকে বাঁকখালী নদীর ৫ একর জায়গা ভরাট করা হয়েছে। দখলে নেওয়া হয়েছে ৫০ কোটি টাকা মূল্যের সরকারি খাস জমি। শহরের উত্তর নুনিয়াছড়া থেকে মাঝেরঘাট পর্যন্ত নদীর প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের বেশি অংশে নতুন করে দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। বাঁকখালী নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে তৈরি হয়েছে চিংড়ি ঘের, লবণ উত্পাদনের মাঠ, প্লট বিক্রির হাউজিং কোম্পানি, নৌযান মেরামতের ডকইয়ার্ড, বরফ কল ও শুঁটকিমহালসহ অসংখ্য ঘরবাড়ি।

কক্সবাজার শহরের ছয় নম্বর জেটিঘাটের অবস্থা করুণ। ময়লার স্তূপে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন নৌযানগুলো জেটিতে ভিড় করতে পারছে না। হাঁটু পরিমাণ কাদাপানি পেরিয়ে নৌযানে ওঠতে হয় যাত্রীদের। প্রায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী কক্সবাজার সদর উপজেলার বাংলাবাজার থেকে শহরের নুনিয়াছরা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার অংশে দিন দিন দখল বাড়ছে। সরকারি তালিকায় দখলদারদের সংখ্যা ২২০ জন। এর মধ্যে জেলা প্রশাসকের তালিকায় রয়েছে ৭৯ জন, উপকূলীয় বনবিভাগের তালিকায় ৭১ জন এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের তালিকায় রয়েছে ৭০ জন। তবে সরকারি তালিকার বাইরে আরো অন্তত হাজারো দখলদার রয়েছে।

নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে রামুর সিকলঘাট বাজার, মিঠাছড়ি ইউনিয়নের বিভিন্ন ষ্টেশন, সদর উপজেলার বাংলা বাজার। ছোট-বড় শত শত দোকানপাট রয়েছে এসব বাজার ও ষ্টেশনে। এ ছাড়া বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বসবাস করে কয়েক হাজার মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে লিংকরোড় ও বাংলা বাজার সংলগ্ন কয়েকটি স্থানে বাঁকখালীতে বর্জ্য ফেলছে স্থানীয়রা। বিভিন্ন পোল্টি ফার্ম এবং রামুর কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বাজারের বর্জ্যও সরাসরি নদীতে ফেলা হয়।

ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, নির্দিষ্ট জায়গাতে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে বলা হলেও তারা ফেলেনা। প্রতিদিন রাত্রে বিভিন্ন জায়গার পোল্টি ফার্মের বর্জ্য গাড়িতে করে এনে ছমুদা ব্রিজের উপরে দাড়িয়ে নদীতে ফেলা হচ্ছে। সরকারিভাবে কোন আইন না থাকায় কেউ বাঁধা দিলেও কথা শুনেনা। মিঠাছড়ি-খরুলিয়া পয়ন্টের ঘাটের মাঝি ছৈয়দ আলম জানান, ঘাট এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বর্জ্য ফেলায় যাত্রীসহ চলাচলকারী লোকজনকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। প্রকট দুর্গন্ধে নাক চেপে চলাচল করতে হয়।

কক্সবাজার নদী পরিব্রাজক দলের সভাপতি এডভোকেট আবুহেনা মোস্তফা কামাল জানান, শুধু বাঁকখালী নয়, ফারিখাল, মাতামুহুরি, রেজুখালসহ প্রায় সব কটি নদীই আজ দূষণের কবলে। বর্ষায় নদ-নদীতে পানি বেশি থাকায় দূষণের মাত্রা বোঝা যায় না। শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি কলমের কালির মতো দেখায়। পোল্টি ফার্মের বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) না থাকায় দূষিত পানি সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এত দিন বাঁকখালী পানি স্বচ্ছ ছিল। এখন সেই পানিও মারাত্মক দূষণের কবলে পড়েছে।

উদীচী শিল্পগোষ্ঠীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতা জানান, দখলের পর দূষণে নদী এখন নতুন সংকটে। রামু বাজার, মিঠাছড়ি, কাউয়ারখোপ, ও গর্জনিয়া বাজার এলাকায় সরাসরি নদীতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। রামু বাজারের প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকায় সব ধরনের বর্জ্য ফেলায় বিষাক্ত হয়ে উঠছে নদী ও আশপাশের পরিবেশ।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান বলেন, নদীদূষণের বিষয়ে সরেজমিন দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোঃ নুরুল আমিন বলেন, নদীতে বর্জ্য ফেলার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে রামু ও সদর উপজেলার স্থানগুলো পরিদর্শনের মাধ্যমে বর্জ্য অপসারণ বন্ধ করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।